শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১১ অপরাহ্ন
মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ক্রমাগত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এসব রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ-সংঘাতের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। একই সঙ্গে মাদক ব্যবসা, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
নানা অপরাধের পাশাপাশি একটি চক্রের ইন্ধনে বাংলাদেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টাও করছে বলে দায়িত্বশীল সংস্থার প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এতে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা।
রোহিঙ্গাদের দিয়ে একটি চক্র দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। এতে এসব রোহিঙ্গাদের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা শঙ্কাও। যার প্রেক্ষিতে প্রশাসনিকভাবে কঠোর নজরদারীও নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এনজিও কর্মী ছদ্মবেশে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্দেহজনক ঘুরাঘুরির সময় ৫ বিদেশী নাগরিকসহ ছাব্বিশ জনকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এদের আটক করা হয় বলে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) খালেদ মাহমুদ।
এডিএম খালেদ মাহমুদ বলেন, প্রশাসনের নির্দেশনা অমান্য করে সোমবার রাতে বহিরাগত কিছু উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া এলাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অবস্থান করে সন্দেহজনক আচরণের খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। এসময় ক্যাম্পটির ডি-৪ ব্লক থেকে বিদেশী পাঁচ নাগরিকসহ ২৬ জনকে আটক করা হয়।
তিনি জানান, শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ ধরণের আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু বর্তমানে স্থানীয়দের সাথে বিরোধের পাশাপাশি নিজের মধ্যে সংঘর্ষ ও সংঘাতের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে কঠোর নজরদারী বাড়ানো হয়েছে।
কিছু-কিছু রোহিঙ্গার কারণে এই বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করেছে অনেক রোহিঙ্গাও।
এর মধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পের আবদুল গফুর নামের এক বৃদ্ধ জানান, এক শ্রেণীর রোহিঙ্গারা নিজের ইচ্ছায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গারা নিবন্ধনে প্রতিবন্ধকতা তৈরী, ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম সহ নানা অপরাধেও জড়িত রয়েছে।
বাংলাদেশে মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মালেক নামের অপর এক রোহিঙ্গা জানান, রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে অপরাধী করার জন্য চেষ্টা করছে কিছু মহল। এতে বাংলাদেশেও রোহিঙ্গারা অবহেলিত হতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কুতুপালং এলাকার নুরুল হক জানান, অত্যাচারের মধ্যদিয়ে বেড়ে ওঠার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে আইনশৃঙ্খলা মানে না। এসব রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ ঘটাচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সকল রোহিঙ্গাকে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হোক এমনটা দাবি স্থানীয়দের।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা জানান, রোহিঙ্গারা কোনভাবেই সহজ সরল না। তাদের মধ্যে নানাভাবে অপরাধ প্রবণতা রয়েছে। এরা আক্রোশ মনোভাবেরও। সব বিবেচনা করেই প্রশাসনকে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে। অন্যথায় আরও অপরাধ বাড়তে পারে। যা আমাদের নিরনাপত্তার জন্য হুমকি বটে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, রোহিঙ্গারা এখন নয়, অনেক আগে থেকে আইন শৃঙ্খলার জন্য হুমকি। নতুন করে পানির ঢলের মতো রোহিঙ্গা আসায় সেই শঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের চলা ফেরা নিয়ন্ত্রণ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব রোহিঙ্গাদের এক স্থানে করে দ্রুত সময়ের মধ্যে এদের ফেরত পাঠানো জরুরী।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সভাপতি নুরুল আবছার জানান, আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার ইন্ধনেই রোহিঙ্গা বিদ্রোহী আরএসএ তৈরি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন মিশনে ব্যবহার হয়েছে এসব বিদ্রোহীরা। বিভিন্ন সময় পাকিস্তান পন্থি বাংলাাদেশে সম্প্রদায়িক একটি শক্তি নানাভাবে নাশকতা তৈরির চেষ্টা করেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে একই কাজটি করার চেষ্টা চলছে। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে নলকূপ শ্রমিকের উপর হামলা ভয়াবহ ইঙ্গিত। মানবিক বিকবেচনায় আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গাদের এসব আচরণ বন্ধে কঠোর হতে হবে। বিশেষ মহলকে চিহ্নিত করেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা এখন ৮ লাখকক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল জানান, রোহিঙ্গা কেন্দ্রিক পুলিশি তৎপরতা অনেক বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারীও। স্থায়ীভাবে পুলিশ ক্যাম্পও করার প্রক্রিয়া চলছে। অপরাধ বা অন্যায় কাজ যাতে হতে না পারে তার জন্য সজাগ রয়েছে পুলিশ।
সকল ধরণের সহায়তা প্রদানের পরও ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে মরিয়া কিছু রোহিঙ্গারা। এ পর্যন্ত ৩১ হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) খালেদ মাহমুদ জানান, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা নানাভাবে বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করার তথ্য রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বুধবার থেকে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে প্রশাসন। মাইকিং করে এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য ভাড়া বাড়ির মালিকদের অনুরোধ করা হবে। যদি কেউ না মানেন নিদিষ্ট সময় পর বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, গত ২১ অক্টোবর টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে কবির আহমদ নামে এক এসআইকে পিটিয়ে আহত করেছে রোহিঙ্গারা। এর আগে ১৯ অক্টোবর রোহিঙ্গারা হামলায় চালিয়ে টেকনাফের হ্নীলায় ইউনিয়নের আবু সিদ্দিক নামের এক যুবককে আহত করে। ২১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান এ যুবক।
৩০ অক্টোবর ডাকাতির প্রস্তুতির সময় উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প সংলগ্ন বাগান থেকে দেশীয় তৈরি অস্ত্রসহ ৫ রোহিঙ্গাকে আটক করে র্যাব। ২৭ অক্টোবর রামুর খুনিয়াপালংয়ে আব্দুল জব্বার নামে এক বাঙ্গালী যুবককে কুপিয়ে হত্যা করছে এক রোহিঙ্গা। একই দিন বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের হামলায় ৪ জন নলকূপ শ্রমিক আহত হয়েছে। এ দিন দেশে তৈরি ২টি বন্দুকসহ ২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। ২৮ অক্টোবর রাতে টেকনাফের হ্নীলায় এক বাড়ি থেকে ৬ টি মোবাইল চুরি করে পালিয়ে যাবার সময় জাবেদ নামে রোহিঙ্গা যুবককে আটক করা হয়। এছাড়া গত এক মাসের রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটিয়েছে কম পক্ষে ৫০টির বেশি। অস্ত্রসহ নানা অপরাধে চলতি মাসে ২০ জন রোহিঙ্গাকে আটকও করা হয়েছে। মঙ্গলবার এক রোহিঙ্গা নারী ইয়াবাসহ আটক হয়েছে। এর আগে গত ৩ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের এক ঘর থেকে ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থার তথ্য মতে, গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে ৫ লাখ রোহিঙ্গা ছিল এদেশে। রোহিঙ্গারা বসবাস করছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। এসব রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ মানবিক সহায়তা প্রদান করা হলেও অনেকে হত্যাসহ নানা অঘটন ঘটাচ্ছে।